Top News

সহিংস পরিবেশে সংস্কার টিকবে না: টিআই চেয়ারম্যান


 বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ারম্যান ফ্রাঁসোয়া ভালেরিয়াঁ। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, দেশে যদি সহিংসতা অব্যাহত থাকে, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের কর্মীদের ওপর হয়রানি, হুমকি এবং হামলা চলতেই থাকে, তবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারগুলো টেকসই হবে না, বরং ব্যর্থ হয়ে পড়বে।


বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে সংবাদকর্মীদের ওপর ক্রমবর্ধমান হামলা ও হয়রানির ঘটনাকে ‘চরম উদ্বেগজনক’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং বলেন, দুর্নীতি মোকাবিলা ও সংস্কারকে কার্যকর করতে মুক্ত, স্বাধীন ও নিরাপদ সাংবাদিকতা অপরিহার্য।


ভালেরিয়াঁ বলেন, দুর্নীতিকে পুষ্ট করে তোলে ‘গোপনীয়তার সংস্কৃতি’। যখন তথ্য গোপন রাখা হয় এবং সমালোচনার সুযোগ সীমিত করা হয়, তখন দুর্নীতি আরও বেড়ে যায়। ফলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, আগের সরকারের সময় প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এই বিপুল অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় সরকারি সেবার কাঠামো ভেঙে পড়েছে, বৈষম্য বেড়েছে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ ব্যাহত হয়েছে।


তার ভাষায়, “যদি এ অর্থ লুটপাট না হতো, তাহলে দারিদ্র্য আরও কার্যকরভাবে কমানো যেত। লাখো মানুষ উন্নত সেবা পেত।”


সংস্কার কমিশনে টিআইবির অংশগ্রহণকে ‘সঠিক ও সময়োপযোগী’ সিদ্ধান্ত আখ্যা দিয়ে ফ্রাঁসোয়া ভালেরিয়াঁ বলেন, “একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে টিআইবিকে অবশ্যই ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে, তবে একইসঙ্গে সেই ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সমালোচনার স্বাধীনতাও থাকতে হবে।”


তিনি বাংলাদেশের সুশীল সমাজকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “গত বছর তারা একটি স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেখানে স্বৈরতন্ত্র বাড়ছে, সেখানে বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা অনুপ্রেরণামূলক।”


ভালেরিয়াঁ আরও বলেন, গত আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সংস্কারগুলোকে টেকসই করতে হবে এবং এগুলোতে সুশীল সমাজের সক্রিয় নজরদারি থাকতে হবে। জবাবদিহি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো দেশই বলতে পারবে না যে, তারা দুর্নীতি নির্মূল করেছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, “কোনো দেশেই দুর্নীতি সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায় না। প্রতিনিয়ত এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।”


তিনি আরও পরামর্শ দেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।


সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার আলোচনায় তিনি ‘সত্যিকারের অঙ্গীকার’ পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই চায় এ পরিবর্তন সফল হোক এবং জনগণের আস্থা ফিরে আসুক।


তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের ত্যাগ-তিতিক্ষা অর্থহীন হতে পারে না। জনগণের যে রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে এই পরিবর্তন এসেছে, সেটিকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।”


সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অর্থপাচার প্রসঙ্গে বলেন, প্রতি বছর অর্থপাচারের কারণে বাংলাদেশের জিডিপির অন্তত ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি হয়। গত ১৫ বছরে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যার একটি অংশ বিদেশে জব্দ করা হলেও তা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।


তার মতে, “আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত অর্থপাচার প্রতিরোধ করা। বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার চেয়ে প্রতিরোধ করা অনেক সহজ ও কার্যকর।”


তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের কারণে বড় আকারের অর্থপাচারের সুযোগ কিছুটা কমেছে। তবে এখনও বাণিজ্য মূল্যের কারসাজি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।


ড. ইফতেখারুজ্জামান স্পষ্ট করে জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের যে কমিশন করা হয়েছিল, সেখানে টিআইবির অংশগ্রহণ ছিল পুরোপুরি স্বাধীন এবং এর অর্থায়ন করেছে টিআইবি নিজেই, সরকার নয়। তার ভাষায়, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দুদকের কার্যকর স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।”


টিআই চেয়ারম্যানের এ বক্তব্য এবং টিআইবির বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে দিচ্ছে—বাংলাদেশে চলমান সংস্কার শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা টেকসই করতে হলে স্বাধীন সাংবাদিকতা, সুশীল সমাজের সক্রিয় ভূমিকা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী জবাবদিহির পরিবেশ অপরিহার্য। অন্যথায়, জনগণের ত্যাগ ও স্বপ্ন আবারও বিফল হয়ে যেতে পারে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন