ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি, নৈরাজ্য। সর্বদলীয়ভাবে যে মৌলিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাকে অবশ্যই গঠনশীল, গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে ঐতিহাসিক বলে সীমিতভাবে হলেও অভিহিত করা যায়। এখন বাকি সবকিছু নির্ভর করছে গৃহীত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলোর সফল বাস্তবায়নের ওপর। রাজনৈতিক কিংবা সাংবিধানিক পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। রাতারাতি সব পরিবর্তন কিংবা সংস্কার একসঙ্গে সম্পন্ন করা অতীতে কখনো তেমনভাবে সম্ভব হয়নি। সে কারণেই ধাপে ধাপে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর সেটিকেই গণতান্ত্রিক মহল বলে থাকে ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’।
চুয়ান্নতে মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক প্রজা পার্টির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারা। কিন্তু পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেয়। সেই থেকে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মুক্তি আন্দোলনের পথে রাজনীতি পরিচালনা করছিলেন ভাসানী। সাতান্ন সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় নীতিগত কারণে নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন ভাসানী। তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন তাঁর ছয় দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি।
তারই ধারাবাহিকতায় সূচিত হয়েছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। তাতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। শেখ মুজিব সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করতে পারেননি। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক।
আর একাত্তরে পাক হানাদারবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়লে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান সিপাহি-জনতার এক অভ্যুত্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের শাসনামল এবং পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে প্রচুর আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে। কিন্তু বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অভাবে স্থিতিশীলতা আসেনি কখনো। ক্ষমতা দখলের চক্রান্তে কিংবা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কারণে গণতান্ত্রিক মতাদর্শ কখনোই থিতু হতে পারেনি বাংলাদেশে।
ফলে বারবার জন্ম নিয়েছে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ। সেই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় বিগত চব্বিশের জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান, রাষ্ট্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব এবং জুলাই ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম।
বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে এই রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সহযোগিতা প্রদান করেছে। আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি সুবর্ণপথ বিনির্মাণ করবে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন