রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার নূর নেছা কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রশিদ ইমনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাত এবং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রবাসী মুহাম্মদ আব্দুস সালামকে জীবননাশের হুমকির অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্তে নেমেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।
গত শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সহকারী কলেজ পরিদর্শক মোহাম্মদ লোকমান মুন্সি ও সেকশন অফিসার মো. হিরু শেখ কলেজে সরেজমিন তদন্তকার্য পরিচালনাকালে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রশিদ (৩৫) এবং কলেজের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটির কাছে কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রশিদের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও আয়-ব্যয়ের ভাউচার উপস্থাপন করতে পারেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী দল ১১টি বিষয়ের মধ্যে কলেজের পাঠদানের অনুমতিপত্র, কলেজের নামে জমির কাগজ, প্রথম ও শেষ কমিটির কাগজ, শেষ অনুমতি পত্র, অধ্যক্ষসহ শিক্ষক কর্মচারীর নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কাগজ, অডিট রিপোর্ট হালনাগাদ, বিগত ৩ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল, বিগত দুই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীর সংখ্যা, গত ০১/৬/২০২২ তারিখ থেকে কলেজের একাউন্ট এবং অধ্যক্ষের ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট এবং কলেজ লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যার কাগজপত্র ও প্রমাণাদি আগামী ৭ দিনের মধ্যে বোর্ডে জমা দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
তদন্ত কার্য শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তদন্তকারী দল অভিযোগের সত্যতা বা অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণ পেয়েছেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তারা কোন মন্তব্য করেননি।
জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর গত ৯ জুলাই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আমেরিকা প্রবাসী মুহাম্মদ আব্দুস সালাম লিখিত অভিযোগে বলেন, আমার জন্মভূমি কাটাবাড়ীয়া থেকে প্রায় ৯ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কলেজ নাই। গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে পড়াশুনা থেকে পিছিয়ে না পড়ে সে কারণে আমার মায়ের নিজস্ব জমির ওপর মায়ের নামে নূর নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজটি প্রতিষ্ঠা করি।
গত ০২/০৬/২০২২ তারিখে নূর নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাঁটাবাড়ীয়া গ্রামের মো. হারুনুর রশিদের পুত্র মো. মাহমুদুর রশিদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে কালুখালী উপজেলার মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম স্থান অধিকার করে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সব কিছুই ফ্রি। শিক্ষকদের বেতন, ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন ফ্রি, বই ফ্রি, পোশাক ফ্রি, টিউশন ফি ফ্রি, ভর্তি ফ্রি, পরীক্ষার ফি এমনকি যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে গাড়ীর ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি।
বিদেশ থেকে প্রতিমাসে আমার কষ্টার্জিত লাখ লাখ টাকা কলেজের খরচের জন্য পাঠাই। সমস্ত টাকাই কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহমুদুর রশিদের ডাচ বাংলা ব্যাংক একাউন্টে এবং বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলাম। জুন-২০২২ থেকে অক্টোবর-২০২৪ পর্যন্ত সর্বমোট ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮৬ টাকা পাঠিয়েছি। যা অধ্যক্ষের ব্যাংক একাউন্ট চেক ও বিকাশ একাউন্ট চেক করলে পাওয়া যাবে।
কিন্তু অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদ টাকা পয়সা খরচের কোনো সঠিক হিসাব আমাকে দেন না। হিসাব চাইলেই বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। বহুবার মৌখিকভাবে এবং লিখিতভাবে নোটিশ দেওয়ার পরও কোন উত্তর দেননি। হিসাব চাওয়াতে আমাকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়।
গত ১৩/০২/২০২৫ তারিখে অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদকে প্রথম কারণ দর্শানোর নোটিশ, ২৭/০২/২০২৫ তারিখে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ ও ১৬/০৩/২০২৫ তারিখে তৃতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয় এবং গত ০৬/০৪/২০২৫ তারিখে অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদকে সাময়িক বরখাস্তকরণ নোটিশ প্রদান করা হয়। কিন্তু অদ্যবধি অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদ উল্লেখিত পত্রের কোনো জবাব দেননি যা চাকরি শৃঙ্খলার পরিপন্থি।
নূর নেছা কলেজের সহকারী লাইব্রেরিয়ান টুম্পা বলেন, “আমি ৯ বছর এই কলেজে চাকরি করছি। যে বইগুলো কেনা হয়েছে অধ্যক্ষ স্যার কোনো ভাউচার আমাকে দেননি। আমি তাকে ভাউচারের কথা বললে তিনি আমাকে বলেন এই ভাউচারের বিষয়ে আপনি কোনো কথা বলবেন না। সর্বশেষ তিনি ২০২৫ সালের জুলাই মাসে আমার কাছে যে হিসাবের খাতা ছিল সেখানে হিসাব লিখিয়ে আমার কাছ থেকে খাতাটা নিয়ে গেছে। কিন্তু ভাউচার দেননি।”
স্কুলের সভাপতির প্রতিনিধি আমিরুল হক বলেন, “এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুস সালাম একজন প্রবাসী। তার অর্থে কলেজ পরিচালিত হয়। তিনি প্রবাসে যাওয়ার পর আমাকে সভাপতির প্রতিনিধি বানিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকা থেকে এই কলেজের সমস্ত খরচ অধ্যক্ষের কাছে পাঠাতেন। কিন্তু অধ্যক্ষ সেই টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ দিলে তারা তদন্তে এসেছে।”
আমেরিকা প্রবাসী মুহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, “আমার প্রবাস জীবনের উপার্জিত অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত কলেজে অর্থ খোয়ানোই নয়, এখন আমি প্রাণনাশের আশংকাও করছি। ফলে বাধ্য হয়ে জীবনের নিরাপত্তা, প্রেরিত টাকা ফেরত ও প্রতারক অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদের সুষ্ঠ বিচার চেয়ে গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি এবং গত ১০ জুলাই নিউইয়র্কের কনস্যুলেট জেনারেলের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় পৃথক অভিযোগ দায়ের করি।”
আব্দুস সালাম আরও বলেন, “আমার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খরচ চালিয়েছি আর সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য আজকে আমার জীবনের ওপর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি আমার কষ্টার্জিত টাকা উদ্ধার এবং যথাযথ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের প্রতি সুদৃষ্টি কামনা করি।”
কলেজের অধ্যক্ষ মাহমুদুর রশিদ ইমন বলেন, “এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুস সালাম সে আমার আপন কাকা। সে কলেজ চালানোর জন্য টাকা পাঠিয়েছে আমি তা অস্বীকার করব না। তার পাঠানো টাকা আমি কলেজের পেছনে খরচ করেছি। আমি কোনো দুর্নীতি বা অর্থ আত্মসাত করিনি। শিক্ষা বোর্ড থেকে তদন্ত কমিটি এসে সব কিছু খতিয়ে দেখছে তারা।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন